Durga Saptashati Image

।। শ্রীদুর্গায়ৈ নমঃ।।

শ্রীশ্রীদুর্গাসপ্তশতী অথ প্রথমোহধ্যায়ঃ

প্রথম অধ্যায়

মেধা ঋষি কর্তৃক রাজা সুরথ ও সমাধিকে ভগবতীর মহিমা বর্ণন প্রসঙ্গে মধুকৈটভ বধ সংবাদ

বিনিয়োগঃ

ওঁ অস্য শ্রীপ্রথমচরিত্রস্য ব্রহ্মা ঋষিঃ, মহাকালী দেবতা, গায়ত্রী ছন্দঃ, নন্দা শক্তিঃ, রক্তদন্তিকা বীজম্, অগ্নিস্তত্ত্বম্, ঋগ্বেদঃ স্বরূপম্, শ্রীমহাকালীপ্রীত্যর্থে প্রথমচরিত্রজপে বিনিয়োগঃ।

এই প্রথম চরিত্রের ঋষি ব্রহ্মা, দেবতা মহাকালী, ছন্দ গায়ত্রী, শক্তি নন্দা, বীজ রক্তদন্তিকা, তত্ত্ব অগ্নি এবং স্বরূপ ঋগ্বেদ। শ্রীমহাকালী দেবতার প্রীতির জন্য প্রথম চরিত্রের জপে বিনিয়োগ করা হয়।

ধ্যানম্

ওঁ খাং চক্র-গদেষু-চাপ-পরিঘান্ শূলং ভুশুণ্ডীং শিরঃ শঙ্খং সন্দধতীং করৈস্ত্রিনয়নাং সর্বাঙ্গভূষাবৃতাম্। নীলাম্মদ্যুতিমাস্য-পাদদশকাং সেবে মহাকালিকাং যামস্তৌৎ স্বপিতে হরৌ কমলজো হন্তুং মধুং কৈটভম্৷৷ ১ ৷৷

ভগবান বিষ্ণু যোগনিদ্রায় থাকার সময় মধু এবং কৈটভকে বধের জন্য কমলজন্মা ব্রহ্মা যাঁকে স্তব করেছিলেন, সেই মহাকালী দেবীকে আমি সেবা (উপাসনা) করছি। তিনি নিজের দশ হাতে খড়গ, চক্র, গদা, বাণ, ধনুষ, পরিঘ, শূল, ভুশুণ্ডি, নরমুণ্ড ও শঙ্খ ধারণ করেন। তাঁর তিনটী নেত্র। তিনি সর্বাঙ্গে দিব্য আভরণে ভূষিতা। তাঁর শরীরের জ্যোতি নীলকান্তমণির মত। তার দশটা মুখ ও দশটি পা।

ওঁ নমশ্চণ্ডিকায়ৈ

'ওঁ' ঐং মার্কণ্ডেয় উবাচ ।।১ ।।

মহর্ষি মার্কণ্ডেয় বললেন-৷৷ ১ ।।

সাবর্ণিঃ সূর্যতনয়ো যো মনুঃ কথ্যতেহষ্টমঃ।
নিশাময় তদুৎপত্তিং বিস্তরাদ্ গদতো মম৷ ২৷৷

সূর্যপুত্র সাবর্ণি, যিনি অষ্টম মনু বলে কথিত, তাঁর উৎপত্তির (জন্মকাহিনী) কথা বিস্তারিতভাবে বলছি, শোনো। ২॥

মহামায়ানুভাবেন যথা মন্বন্তরাধিপঃ।
স বভূব মহাভাগঃ সাবর্ণিন্তনয়ো রবেঃ৷ ৩ ॥

সূর্যতনয় মহাভাগ (মহাঐশ্বর্যশালী) সাবর্ণি ভগবতী মহামায়ার অনুগ্রহে যে ভাবে মন্বন্তরাধিপতি হয়েছিলেন, সেই প্রসঙ্গ শোনাচ্ছি। ৩ ।

স্বারোচিষেহন্তরে পূর্বং চৈত্রবংশসমুদ্ভবঃ।
সুরথো নাম রাজাহভূৎ সমস্তে ক্ষিতিমণ্ডলে।॥ 8 ॥

পূর্বকালে এ স্বারোচিষ মন্বন্তরে সুরথ নামে এক রাজা ছিলেন, যিনি চৈত্রবংশে জন্মেছিলেন, তিনি সমগ্র ভূমণ্ডলের অধিপতি হয়েছিলেন। ৪ ৷৷

তস্য পালয়তঃ সম্যক্ প্রজাঃ পুত্রানিবৌরসান্।
বভূবুঃ শত্রবো ভূপাঃ কোলাবিধ্বংসিনস্তদা৷৷ ৫ ৷৷

তাঁর প্রজাদের তিনি নিজ ঔরসজাত পুত্রের মতো নীতিশাস্ত্রমতে পালন করতেন; তবুও সেই সময় কোলাবিধ্বংসী নামক ক্ষত্রিয় তাঁর শত্রু হয়েছিল।। ৫ ॥

তস্য তৈরভবদ্ যুদ্ধমতিপ্রবলদণ্ডিনঃ।
ন্যূনৈরপি স তৈযুদ্ধে কোলাবিধ্বং সিভির্জিতঃ৷৷ ৬৷৷

সুরথরাজার দণ্ডনীতি বড়ই প্রবল ছিল। শত্রুদের সাথে তাঁর যুদ্ধ হয়েছিল। কোলাবিধ্বংসীরা যদিও সংখ্যায় কম ছিল তবুও রাজা সুরথ যুদ্ধে পরাস্ত হয়েছিলেন।। ৬ ।।

ততঃ স্বপুরমায়াতো নিজদেশাধিপোহভবৎ।
আক্রান্তঃ স মহাভাগস্তৈস্তদা প্রবলারিভিঃ ।। ৭ ৷৷

তখন তিনি রণভূমি থেকে প্রত্যাগমন করে এসে কেবলমাত্র নিজের দেশের রাজা হয়ে থেকে গেলেন (সমগ্র পৃথিবী থেকে তাঁর অধিকার চলে যেতে থাকল), কিন্তু সেখানেও সেই প্রবল শত্রুরা সেই সময় এসে মহাভাগ রাজা সুরথকে আক্রমণ করল। ৭ ॥

অমাত্যৈর্বলিভিদুষ্টেদুর্বলস্য দুরাত্মভিঃ।
কোষো বলঞ্চাপহৃতং তত্রাপি স্বপুরে ততঃ ৷৷ ৮ ৷৷

রাজার শক্তি কমে যাচ্ছিল; তার ফলে তাঁর দুষ্ট, বলবান এবং দুরাত্মা মন্ত্রীগণ সেই রাজধানীতেও রাজকীয় সৈন্যসামন্ত ও কোষাগার অধিকার করে নিল। ৮ ।

ততো মৃগয়াব্যাজেন হৃতস্বাম্যঃ স ভূপতিঃ।
একাকী হয়মারুহ্য জগাম গহনং বনম্৷ ৯৷৷

সুরথের প্রভুত্ব নষ্ট হয়ে যাওয়াতে তিনি মৃগয়ার উদ্দেশ্যে ঘোড়ায় চড়ে একলাই এক গভীর অরণ্যে গমন করলেন। ৯ ৷৷

স তত্রাশ্রমমদ্রাক্ষীদ্ দ্বিজবর্যস্য মেধসঃ।
প্রশান্তশ্বাপদাকীর্ণং মুনিশিষ্যোপশোভিতম্।। ১০ ৷৷

সেখানে তিনি দ্বিজবর মেধা ঋষির আশ্রম দেখতে পেলেন, যেখানে হিংস্র জন্তরাও নিজেদের স্বাভাবিক হিংসাবৃত্তি ত্যাগ করে পরস্পর শান্তভাবে বাস করত। মুনির অনেক শিষ্য সেই আশ্রমের শোভাবর্দ্ধন করত ৷৷ ১০ ৷৷

তছৌ কঞ্চিৎ স কালঞ্চ মুনিনা তেন সৎকৃতঃ।
ইতশ্চেতশ্চ বিচরংস্তস্মিন্ মুনিবরাশ্রমে।। ১১ ৷৷

সেখানে যাওয়ার পর তিনি মুনির দ্বারা সমাদৃত হয়ে সেই মুনিবরের আশ্রমে ইতস্ততঃ ঘোরাফেরা করে কিছু সময় কাটালেন।। ১১ ৷৷

সোহচিন্তয়ত্তদা তত্র মমত্বাকৃষ্টচেতনঃ ।
মৎপূর্বৈঃ পালিতং পূর্বং ময়া হীনং পুরং হি তৎ৷৷ ১২ ৷৷

মত্যৈন্তৈরসদৃত্তৈর্ধর্মতঃ পাল্যতে ন বা।
ন জানে স প্রধানো মে শূরহস্তী সদামদঃ।। ১৩।

মম বৈরিবশং যাতঃ কান্ ভোগানুপলপ্স্যতে।
যে মমানুগতা নিত্যং প্রসাদ-ধন-ভোজনৈঃ৷৷ ১৪৷৷

অনুবৃত্তিং ধ্রুবং তেহদ্য কুর্বন্ত্যন্যমহীভূতাম্।
অসম্যগ্‌ ব্যয়শীলৈস্তৈঃ কুর্বন্তিঃ সততং ব্যয়ম্।। ১৫ ৷৷

সঞ্চিতঃ সোহতিদুঃখেন ক্ষয়ং কোষো গমিষ্যতি।
এতচ্চান্যচ্চ সততং চিন্তয়ামাস পার্থিবঃ৷৷ ১৬৷৷

তত্র বিপ্রাশ্রমাভ্যাসে বৈশ্যমেকং দদর্শ সঃ।
স পৃষ্টস্তেন কস্তুং ভো হেতুশ্চাগমনেহত্র কঃ। ১৭৷৷

সশোক ইব কস্মাত্ত্বং দুর্মনা ইব লক্ষ্যসে।
ইত্যাক্য বচস্তস্য ভূপতেঃ প্রণয়োদিতম্ ৷ ১৮ ৷৷

প্রত্যুবাচ সতং বৈশ্যঃ প্রশ্রয়াবনতো নৃপম্৷ ১৯৷৷

সেখানে মমতাভিভূত চিত্তে তিনি চিন্তা করতে লাগলেন-অতীতে আমার পূর্বপুরুষরা যে নগর সুরক্ষিত রেখেছিলেন, সেই নগর আজ আমার দ্বারা পরিত্যক্ত। আমার দুরাচারী ভৃত্যবর্গ সেই নগর ধর্মানুসারে রক্ষা করেছে কিনা জানি না, সর্বদা মদস্রবী ও মহাবল, আমার প্রধান হস্তী এখন শত্রুদের অধীন হয়ে কেমন সব ভোগ করছে। যে সব লোকেরা আমার অনুগ্রহ, বেতন, ভোজ্যদ্রব্যাদি পেয়ে সর্বদা আমার অনুগত ছিল, তারা নিশ্চয়ই এখন অন্য রাজাদের দাসত্ব করছে। বহুকষ্টে সঞ্চিত আমার সেই ধনরাশি ওই সব অমিতব্যয়ী আমাত্যদের দ্বারা নিয়ত ক্ষয় হতে হতে নিঃশেষ হয়ে যাবে। রাজা সুরথ সর্বদাই এই সমস্ত ঘটনা এবং অন্যান্য দুশ্চিন্তা করতেন। একদিন তিনি সেই দ্বিজবর মেধা মুনির আশ্রমের কাছে এক বৈশ্যকে দেখতে পেলেন এবং তাকে জিজ্ঞাসা করলেন-'মহাশয়! তুমি কে? তুমি এখানে কেন এসেছ? তোমাকে যেন শোকাকুল ও মানসিক বেদনাযুক্ত বলে মনে হচ্ছে?' রাজা সুরথের এই প্রীতিপূর্ণ সম্ভাষণে বিনয়াবনতভাবে সেই বৈশ্য রাজাকে প্রণাম করে প্রত্যুত্তরে বললেন-৷ ১২-১৯।

বৈশ্য উবাচ ৷ ২০॥

বৈশ্য বললেন-॥ ২০ ।।

সমাধিনাম বৈশ্যোহহমুৎপন্নো ধনিনাং কুলে৷৷ ২১৷৷

হে রাজন! ধনবান বংশে জাত আমি এক বৈশ্য। আমার নাম সমাধি।। ২১ ।।

পুত্রদারৈর্নিরস্তশ্চ ধনলোভাদসাধুভিঃ।
বিহীনশ্চ ধনৈর্দারৈঃ পুত্রৈরাদায় মে ধনম্৷৷ ২২৷৷

বনমভ্যাগতো দুঃখী নিরস্তশ্চাপ্তবন্ধুভিঃ।
সোহহং ন বেদ্মি পুত্রাণাং কুশলাকুশলাত্মিকাম্৷ ২৩ ৷৷৷

প্রবৃত্তিং স্বজনানাঞ্চ দারাণাঞ্চাত্র সংস্থিতঃ।
কিছু তেষাং গৃহে ক্ষেমমক্ষেমং কিন্তু সাম্প্রতম্।। ২৪৷৷

আমার দুষ্ট স্ত্রীপুত্রেরা ধনলোভে আমাকে বিতাড়িত করেছে। বর্তমানে আমি ধনসম্পত্তি ও স্ত্রীপুত্রাদির দ্বারা পরিত্যক্ত। আমার বিশ্বস্ত আত্মীয়স্বজনেরা আমার ধনসম্পত্তি আত্মসাৎ করে আমাকে পরিত্যাগ করেছে, এইজন্য দুঃখিত মনে আমি বনে চলে এসেছি। এখানে এসে আমি জানতেও পারছি না যে আমার স্ত্রীপুত্র এবং আত্মীয়-বন্ধুরা কুশলে আছে কিনা? বাড়ীতে এখন তারা কুশলে আছে না কষ্টে আছে কে জানে?।॥ ২২-২৪।।

কথন্তে কিন্তু সত্তা দুর্বৃত্তাঃ কিন্তু মে সুতাঃ৷৷ ২৫৷৷

আমার ছেলেরা কেমন আছে? তারা কি এখনও সদাচারী, নাকি দুরাচারী হয়ে গেছে? ।।২৫৷৷

রাজোবাচ।। ২৬৷৷

রাজা জিজ্ঞাসা করলেন-॥ ২৬ ॥

যৈর্নিরস্তো ভবাঁল্লুব্ধৈঃ পুত্রদারাদিভির্ধনৈঃ ।। ২৭ ৷৷

তেষু কিং ভবতঃ স্নেহমনুবপ্নাতি মানসম্৷ ২৮৷৷

যে সব লোভী স্ত্রীপুত্রগণ অর্থের লোভে তোমাকে ঘরছাড়া করেছে, তাদের জন্য তোমার মন এত স্নেহাসক্ত কেন?। ২৭-২৮।

বৈশ্য উবাচ।। ২৯ ৷৷

বৈশ্য (সমাধি) বললেন-॥ ২৯।

এবমেতদ্ যথা প্রাহ ভবানস্মদ্গতং বচঃ৷৷ ৩০॥

আমার সম্বন্ধে আপনি যা বলছেন তা সবই ঠিক ৷৷ ৩০ ৷৷

কিং করোমি ন বয়াতি মম নিষ্ঠুরতাং মনঃ।
যৈঃ সন্ত্যজ্য পিতৃস্নেহং ধনলুন্ধৈর্নিরাকৃতঃ ৷৷ ৩১৷৷

পতিস্বজনহার্দঞ্চ হার্দি তেম্বেব মে মনঃ।
কিমেতন্নাভিজানামি জানন্নপি মহামতে৷৷ ৩২ ৷৷

যৎ প্রেমপ্রবণং চিত্তং বিগুণেস্বপি বন্ধুযু।
তেষাং কৃতে মে নিঃশ্বাসো দৌর্মনস্যঞ্চ জায়তে।। ৩৩৷৷

কিন্তু কি করব, আমার মন তো নিষ্ঠুর হতে পারছে না। যারা অর্থের লোভে পিতৃস্নেহ, পতিপ্রেম ও স্বজনপ্রীতি জলাঞ্জলি দিয়ে আমাকে বহিষ্কৃত করেছে তাদের প্রতিই আমার মন অনুরক্ত হচ্ছে। হে মহামতি! গুণহীন (স্নেহহীন) বন্ধুদের প্রতিও যে আমার মন এই রকম মমতাযুক্ত হচ্ছে, এর কারণ কি? আমি তো বুঝেও বুঝতে পারছি না। তাদের জন্য আমার দীর্ঘশ্বাস পড়ছে এবং অত্যন্ত দুশ্চিন্তা হচ্ছে।। ৩১-৩৩ ।।

করোমি কিং যন্ন মনস্তেম্বপ্রীতিষু নিষ্ঠুরম্।। ৩৪৷৷

ওরা প্রীতিহীন, তবুও যে ওদের প্রতি আমি নির্দয় হতে পারছি না। আমি কী করব? ॥ ৩৪ ॥

মার্কণ্ডেয় উবাচ।। ৩৫ ৷৷

মার্কণ্ডেয় মুনি বললেন-। ৩৫ ৷৷

ততস্তৌ সহিতৌ বিপ্র তং মুনিং সমুপস্থিতৌ৷ ৩৬ ৷৷

সমাধিনাম বৈশ্যোহসৌ স চ পার্থিবসত্তমঃ।
কৃত্বা তু তৌ যথান্যায়ং যথাৰ্ছং তেন সংবিদম্।। ৩৭ ৷৷

উপবিষ্টৌ কথাঃ কাশ্চিচ্চক্রতুর্বৈশ্যপার্থিবৌ৷৷ ৩৮৷৷

হে ব্রহ্মন্! তখন রাজশ্রেষ্ঠ সুরথ এবং সেই সমাধি নামক বৈশ্য দুজনে একসাথে মেধা ঋষির কাছে গিয়ে যথাযোগ্য বিনীত প্রণাম করে তাঁর সামনে বসলেন। তারপর সেই বৈশ্য এবং রাজা কিছু কথাবার্তা শুরু করলেন। ৩৬-৩৮ ।।

রাজোবাচ ।। ৩৯৷৷

রাজা বললেন-৷৷ ৩৯ ৷৷

ভগবংস্ত্রামহং প্রষ্টুমিচ্ছাম্যেকং বদস্ব তৎ৷ ৪০৷

হে ভগবন্! আমি আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করি। অনুগ্রহ করে তার উত্তর আমাকে বলুন। ৪০ ।।

দুঃখায় যন্মে মনসঃ স্বচিত্তায়ত্ততাং বিনা।
মমত্বং গতরাজ্যস্য রাজ্যাঙ্গেম্বখিলেম্বপি৷৷ ৪১৷৷

আমার মন আমার নিজের বশীভূত না থাকায় এই প্রশ্ন সর্বদাই আমাকে দুঃখ দিচ্ছে। যে রাজ্য আমার হাতের বাহিরে চলে গেছে, সেই রাজ্যের প্রতি এবং তার সব কিছুর প্রতি আমার মমতা বদ্ধ হয়ে রয়েছে। ৪১ ৷৷

জানতোহপি যথাজ্ঞস্য কিমেতমুনিসত্তম।
অয়ঞ্চ নিকৃতঃ পুত্রৈর্দারৈভৃত্যৈস্তথোজঝিতঃ৷৷ ৪২ ৷৷

হে মুনিসত্তম! সেই রাজ্য যে আমার আর নেই তা জানা সত্ত্বেও অজ্ঞানীর মতো সেই রাজ্য এবং রাজ্যের বিভিন্ন বস্তুর জন্য আমার মন বিষাদগ্রস্ত, এর কারণ কী? এখানে এই বৈশ্যও স্ত্রীপুত্রদের দ্বারা বাড়ী থেকে বিতাড়িত, অপমানিত হয়ে এসেছেন। পুত্র, স্ত্রী এবং ভৃত্যেরা একে ছেড়ে গেছে। ৪২ ৷৷

স্বজনেন চ সন্ত্যক্তস্তেষু হার্দী তথাপ্যতি।
এবমেষ তথাহঞ্চ দ্বাবপ্যত্যন্তদুঃখিতৌ। ৪৩৷৷

স্বজনরাও তাকে পরিত্যাগ করেছে, তবুও তাদের প্রতি এই বৈশ্য অতিশয় আসক্ত। এই পরিস্থিতিতে ইনি এবং আমি দুজনেই অত্যন্ত দুঃখিত হয়ে রয়েছি।। ৪৩ ।।

দৃষ্টদোষেহপি বিষয়ে মমত্বাকৃষ্টমানসৌ।
তৎ কিমেতন্মহাভাগ যন্মোহো জ্ঞানিনোরপি। ৪৪ ৷৷৷

মমাস্য চ ভবত্যেষা বিবেকান্ধস্য মূঢ়তা৷৷ ৪৫ ৷৷

যেখানে যে ব্যাপারে আমরা প্রত্যক্ষভাবে দোষ দেখতে পাচ্ছি, সেই বিষয়ের প্রতিও আমাদের মনে মমতাজনিত আকর্ষণ জন্মাচ্ছে। হে মহাভাগ! আমরা দুজনেই বুদ্ধিমান, তথাপি আমাদের মনে যে মোহ উৎপন্ন হয়েছে, এটা কেন? বিবেক-হীন মানুষের মত এই রকম মূঢ়তা, আমার এবং এর মধ্যেও কেন? ।।॥ ৪৪-৪৫ ॥

ঋষিরুবাচ ।। ৪৬।।

ঋষি বললেন-৷৷ ৪৬ ৷৷

জ্ঞানমস্তি সমস্তস্য জন্তোবিষয়গোচরে ।। ৪৭৷৷

হে মহামতে! সব প্রাণীরই রূপ, রস প্রভৃতি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বিষয়ে জ্ঞান আছে ৷৷ ৪৭ ৷৷

বিষয়শ্চা(১) মহাভাগ যাতি চৈবং পৃথক্ পৃথক্।
দিবান্ধাঃ প্রাণিনঃ কেচিদ্রাত্রাবন্ধাস্তথাপরে। ৪৮৷৷

এইরকম বিষয়সমূহও প্রত্যেকের জন্য আলাদা আলাদা, কোনও প্রাণী দিনের বেলায় দেখতে পায় না, তাই সে রূপএর বিষয় দিনের বেলায় অজ্ঞান, আবার কোনও প্রাণী রাতের বেলা দেখতে পায় না, সে রাত্রিবেলা রূপের বিষয়ে অজ্ঞান।। ৪৮ ।।

কেচিদ্দিবা তথা রাত্রৌ প্রাণিনগুল্যদৃষ্টয়ঃ।
জ্ঞানিনো মনুজাঃ সত্যং কিং তুতেন হি কেবলম্৷ ৪৯ ৷৷

আবার কিছু প্রাণী আছে যারা দিনে ও রাত্রে একই রকমভাবে দেখতে পায়, একথা সত্যি যে মানুষ জ্ঞানবান কিন্তু মানুষই কেবল এরকম নয়। ৪৯ ।।

যতো হি জ্ঞানিনঃ সর্বে পশুপক্ষিমৃগাদয়ঃ।
জ্ঞানঞ্চ তন্মনুষ্যাণাং যত্তেষাং মৃগপক্ষিণাম্ ৷ ৫০৷৷

পশু, পাখী, মৃগ ইত্যাদি সব প্রাণীরই বিষয়জ্ঞান আছে।
মানুষের জ্ঞানও পশুপাখীদের বিষয়জ্ঞানের মতো ।। ৫০ ।।

মনুষ্যাণাঞ্চ যত্তেষাং তুল্যমন্যৎ তথোভয়োঃ।
জ্ঞানেহপি সতি পশ্যৈতান্ পতঙ্গাঞ্জাবচঞ্চুষু৷৷ ৫১ ৷৷

কণমোক্ষাদৃতান্ মোহাৎ পীড্যমানানপি ক্ষুধা।
মানুষা মনুজব্যাঘ্র সাভিলাষাঃ সুতান্ প্রতি৷৷ ৫২ ৷৷

লোভাৎ প্রত্যুপকারায় নন্বেতান্‌ কিং ন পশ্যসি।
তথাপি মমতাবর্তে মোহগর্তে নিপাতিতাঃ ।। ৫৩॥

মহামায়াপ্রভাবেণ সংসারস্থিতিকারিণা।
তন্নাত্র বিস্ময়ঃ কার্যো যোগনিদ্রা জগৎপতেঃ ৷৷ ৫৪।।

মহামায়া হরেশ্চৈষা) তয়া সংমোহ্যতে জগৎ।
জ্ঞানিনামপি চেতাংসি দেবী ভগবতী হি সা৷৷ ৫৫ ॥

বলাদাকৃষ্য মোহায় মহামায়া প্রযচ্ছতি।
তয়া বিসৃজ্যতে বিশ্বং জগদেতচ্চরাচরম্৷৷ ৫৬৷৷

সৈষা প্রসন্না বরদা নৃণাং ভবতি মুক্তয়ে।
সা বিদ্যা পরমা মুক্তের্হেতুভূতা সনাতনী। ৫৭ ॥

সংসারবন্ধহেতুশ্চ সৈব সর্বেশ্বরেশ্বরী। ৫৮ ৷৷

আবার মানুষেরও যেরকম বিষয়জ্ঞান পশুপাখীদেরও তেমনই। এই বিষয়জ্ঞান তথা অন্যান্য ব্যাপারেও উভয়েরই জ্ঞান সমান সমান। দেখ, জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও পাখীরা নিজে ক্ষুধার্ত হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র মোহের বশে নিজের বাচ্চাদের মুখে খাবারের দানা দিয়ে দেয়। হে নরশ্রেষ্ঠ! দেখলেই বুঝতে পারবে যে মানুষ জ্ঞানী হয়েও শুধুমাত্র লোভের বশে প্রত্যুপকারের আশায় পুত্রসন্তানদের কামনা করে? যদিও এদের কারুর মধ্যেই জ্ঞানের অভাব নেই, তবুও সংসারের স্থিতিকারিণী (জন্ম-মৃত্যুপরম্পরা) ভগবতী মহামায়ার প্রভাবে এরা সকলে মমতারূপ আবর্তযুক্ত মোহরূপ গর্তে পড়ে আছে। অতএব এই ব্যাপারে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। জগৎপতি ভগবান বিষ্ণুর যোগনিদ্রারূপা যে ভগবতী মহামায়া, তাঁর দ্বারাই এই জগৎ মোহিত হয়ে রয়েছে। সেই ভগবতী দেবী মহামায়া জ্ঞানীদের চিত্তকে বলপূর্বক আকর্ষণ করে মোহাবৃত করেন। তিনিই এই সম্পূর্ণ চরাচর জগৎ সৃষ্টি করেন, আবার তিনিই প্রসন্না হলে মানুষকে মুক্তিলাভের জন্য বরদান করেন। তিনিই সংসার বন্ধন ও মোক্ষের কারণস্বরূপা পরাবিদ্যা ও সনাতনী (অন্তবিহীনা) দেবী তথা ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বরাদি সকল ঈশ্বরের ঈশ্বরী।। ৫১-৫৮ ॥

রাজোবাচ ।। ৫৯৷৷

ভগবন্ কা হি সা দেবী মহামায়েতি যাং ভবান্৷ ৬০ ৷৷

ব্রবীতি কথমুৎপন্না সা কর্মাস্যাশ্চ কিং দ্বিজ।
যৎপ্রভাবা চ সা দেবী যৎস্বরূপা যদুম্ভবা। ৬১ ৷৷

তৎ সর্বং শ্রোতুমিচ্ছামি ত্বত্তো ব্রহ্মবিদাং বর। ৬২ ৷

হে ভগবন্! যাঁকে আপনি মহামায়া বলছেন, সেই দেবী কে? ব্রহ্মন্! তিনি কীরূপে আবির্ভূতা হয়েছেন? তাঁর চরিত্র কীরকম? হে ব্রহ্মবেত্তাগণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ! সেই দেবীর যেরূপ স্বভাব, তাঁর যা স্বরূপ এবং তিনি যেভাবে উৎপন্না হয়েছেন, সেই সবকিছু আপনার শ্রীমুখ থেকে আমরা শুনতে ইচ্ছা করি।। ৬০-৬২ ৷৷

ঋষিরুবাচ।। ৬৩।।

মেধা ঋষি বললেন-।। ৬৩ ।।

নিত্যৈব সা জগমূর্তিস্তয়া সর্বমিদং ততম্ ৷৷ ৬৪ ৷৷

তথাপি তৎসমুৎপত্তির্বহুধা ক্রয়তাং মম।
দেবানাং কার্যসিদ্ধ্যর্থমাবির্ভ বতি সা যদা৷ ৬৫ ৷৷

উৎপন্নেতি তদা লোকে সা নিত্যাপ্যভিধীয়তে।
যোগনিদ্রাং যদা বিষ্ণুর্জগত্যেকার্ণবীকৃতে৷৷ ৬৬ ৷৷

রাজা সুরথ জিজ্ঞাসা করলেন-। ৫৯ ৷৷

আস্তীর্য শেষমভজৎ কল্পান্তে ভগবান্ প্রভুঃ।
তদা দ্বাবসুরৌ ঘোরৌ বিখ্যাতৌ মধুকৈটভৌ৷৷ ৬৭ ৷৷

বিষ্ণুকর্ণমলোড্ডুতৌ হন্তং ব্রহ্মাণমুদ্যতৌ।
স নাভিকমলে বিষ্ণোঃ স্থিতো ব্রহ্মা প্রজাপতিঃ৷৷ ৬৮ ৷৷

দৃষ্টা তাবসুরৌ চোগ্রৌ প্রসুপ্তঞ্চ জনার্দনম্।
তুষ্টাব যোগনিদ্রাং তামেকাগ্রহৃদয়স্থিতঃ ৷৷ ৬৯ ৷৷

বিবোধনার্থায় হরেইরিনেত্রকৃতালয়াম্।
বিশ্বেশ্বরীং জগদ্ধাত্রীং স্থিতিসংহারকারিণীম্ ॥ ৭০॥

নিদ্রাং ভগবতীং বিষ্ণোরতুলাং তেজসঃ প্রভুঃ৷৷ ৭১ ৷৷

হে রাজন! প্রকৃতপক্ষে তো তিনি নিত্যস্বরূপাই। সমগ্র জগৎপ্রপঞ্চ তাঁরই মূর্তিস্বরূপ। তিনি সর্বব্যাপিনী। তথাপি তাঁর আবির্ভাব বহুপ্রকারে হয়ে থাকে। সেইসব কাহিনী আমার কাছে শোনো। তিনি যদিও নিত্যা এবং জন্মমৃত্যুরহিতা, তবুও দেবতাদের কার্যসিদ্ধির জন্য যখন তিনি প্রকট হন, তখন লোকে তাঁকে উৎপন্না বলে থাকে। কল্পান্তে (প্রলয়কালে) সমগ্র জগৎ যখন একার্ণব জলে নিমগ্ন হল আর সকলের প্রভু ভগবান বিষ্ণু শেষনাগকে শয্যারূপে বিস্তৃত করে যোগনিদ্রাকে আশ্রয় করে শুয়ে ছিলেন, সেই সময় তাঁর কর্ণমল থেকে মধু ও কৈটভ নামে দুই ভয়ঙ্কর অসুর উৎপন্ন হল। তারা দুজনে মিলে ব্রহ্মাকে হত্যা করতে উদ্যত হয়। ভগবান বিষ্ণুর নাভিকমলে বিরাজমান প্রজাপতি ব্রহ্মা সেই দুই ভীষণ অসুরকে প্রত্যক্ষ দেখে এবং ভগবান বিষ্ণুকে নিদ্রিত দেখে, একাগ্রচিত্তে ভগবান বিষ্ণুকে জাগাবার উদ্দেশ্য নিয়ে তাঁর চোখে নিবাসিনী যোগনিদ্রার স্তব করতে লাগলেন। এই বিশ্বের জগদীশ্বরী, জগদ্ধাত্রী, স্থিতিসংহারকারিণী এবং তেজঃস্বরূপ ভগবান বিষ্ণুর অনুপম শক্তি, সেই ভগবতী নিদ্রাদেবীকে ভগবান ব্রহ্মা স্তুতি করতে লাগলেন । ৬৪-৭১ ৷৷

ব্রহ্মোবাচ ।। ৭২।

ব্রহ্মা বললেন- ॥ ৭২ ।।

ত্বং স্বাহা ত্বং স্বধা ত্বং হি বষট্কারঃ স্বরাত্মিকা। ৭৩ ৷৷

সুধা ত্বমক্ষরে নিত্যে ত্রিধা মাত্রাত্মিকা স্থিতা।
অর্ধমাত্রাস্থিতা নিত্যা যানুচ্চার্যা বিশেষতঃ।। ৭৪ ৷৷

ত্বমেব সন্ধ্যা সাবিত্রী ত্বং দেবি জননী পরা।
ত্বয়ৈতদ্ ধার্যতে বিশ্বং ত্বয়ৈতৎ সৃজ্যতে জগৎ।। ৭৫ ৷৷

ত্বয়ৈতৎ পাল্যতে দেবি ত্বমৎস্যন্তে চ সর্বদা।
বিসৃষ্টৌ সৃষ্টিরূপা ত্বং স্থিতিরূপা চ পালনে৷ ৭৬৷৷

তথা সংহৃতিরূপান্তে জগতোহস্য জগন্ময়ে।
মহাবিদ্যা মহামায়া মহামেধা মহাস্মৃতিঃ৷৷ ৭৭ ৷৷

মহামোহা চ ভবতী মহাদেবী মহাসুরী।
প্রকৃতিত্ত্বং চ সর্বস্য গুণত্রয়বিভাবিনী৷৷ ৭৮৷৷

কালরাত্রির্মহারাত্রির্মোহরাত্রিশ্চ দারুণা।
ত্বং শ্রীস্তমীশ্বরী ত্বং হ্রীস্ত্রং বুদ্ধির্বোধলক্ষণা৷৷৭৯৷৷

লজ্জা পুষ্টিস্তথা তুষ্টিস্তুং শান্তিঃ ক্ষান্তিরেব চ।
খড়িানী শূলিনী ঘোরা গদিনী চক্রিণী তথা৷৷ ৮০ ৷৷

শঙ্খিনী চাপিনী বাণভুশুণ্ডীপরিঘায়ুধা।
সৌম্যা সৌম্যতরাশেষসৌম্যেভ্যস্তুতিসুন্দরী৷৷ ৮১ ৷৷

পরাপরাণাং পরমা ত্বমেব পরমেশ্বরী।
যচ্চ কিঞ্চিৎ কচিদ্বস্তু সদসদ্ বাখিলাক্সিকে। ৮২ ৷৷

তস্য সর্বস্য যা শক্তিঃ সাত্বং কিং সূয়সে তদা।
যয়া ত্বয়া জগৎস্রষ্টা জগৎপাত্যত্তি যো জগৎ৷৷ ৮৩ ৷৷

সোহপি নিদ্রাবশং নীতঃ কত্ত্বাং স্তোতুমিহেশ্বরঃ।
বিষ্ণুঃ শরীরগ্রহণমহমীশান এব চ৷৷৮৪ ৷৷

কারিতাস্তে যতোহতত্ত্বাং কঃ স্তোতুং শক্তিমান্ ভবেৎ।
সা ত্বমিত্থং প্রভাবৈঃ স্বৈরুদারৈর্দেবি সংস্তুতা৷৷ ৮৫ ৷৷

মোহয়ৈতৌ দুরাধর্ষাবসুরৌ মধুকৈটভৌ।
প্রবোধঞ্চ জগৎস্বামী নীয়তামচ্যুতো লঘু। ৮৬ ৷৷

বোধশ্চ ক্রিয়তামস্য হন্ত্রমেতৌ মহাসুরৌ। ৮৭ ৷৷

দেবি! তুমি স্বাহা, তুমি স্বধা এবং তুমিই বর্ষকার। স্বরও তোমারই স্বরূপ। তুমিই জীবনদায়িনী সুধা। নিত্য অক্ষর প্রণবের অকার, উকার, মকার-এই তিনমাত্রারূপে তুমিই স্থিত, আবার এই তিন মাত্রা ছাড়া বিন্দুরূপা যে নিত্য অর্দ্ধমাত্রা-যাকে বিশেষরূপে আলাদাভাবে উচ্চারণ করা যায় না, তাও তুমিই। দেবি! তুমিই সন্ধ্যা, সাবিত্রী তথা পরম জননী। দেবি! তুমিই এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে ধারণ করে আছ। তোমার থেকেই এই জগতের সৃষ্টি হয়। তোমার দ্বারাই এই জগতের পালন হয় এবং সর্বদা প্রলয়কালে তুমিই এর সংহার কর। জগন্ময়ী দেবি! এই জগতের সৃষ্টিকালে তুমি সৃষ্টিরূপা, পালনকালে স্থিতিরূপা এবং প্রলয়কালে সংহারশক্তিরূপা। তুমিই মহাবিদ্যা, মহামায়া, মহামেধা, মহাস্মৃতি, মহামোহরূপা, মহাদেবী ও মহাসুরী। তুমিই সত্ত্ব রজঃ ও তমঃ এই তিনগুণের সৃষ্টিকারিণী সর্বময়ী প্রকৃতি। ভয়ঙ্কর কালরাত্রি, মহারাত্রি ও মোহরাত্রিও তুমিই। তুমিই শ্রী, তুমিই ঈশ্বরী, তুমিই হ্রী এবং তুমি নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধি। লজ্জা, পুষ্টি, তুষ্টি, শান্তি ও ক্ষমাও তুমিই। তুমি খড়াধারিণী, শূলধারিণী, ঘোররূপা, তথা গদা, চক্র, শঙ্খ ও ধুনর্ধারিণী। বাণ, ভুশুণ্ডী ও পরিঘা-এসবও তোমার অস্ত্র। তুমি সৌম্যা ও সৌম্যতরা-শুধু তাই নয়, যত কিছু সৌম্য এবং সুন্দর পদার্থ আছে, সেই সবের থেকেও তুমি অত্যধিক সুন্দরী, পর ও অপর-সবের উপরে পরমেশ্বরী তুমিই। সুতরাং তোমার স্তুতি কিভাবে হতে পারে? যেই ভগবান এই জগতের সৃষ্টি, স্থিতি ও পালন করেন, সেই ভগবানকেও যখন তুমি নিদ্রাবিষ্ট করে রেখেছ, তখন কে তোমার স্তব করতে সমর্থ? আমাকে, ভগবান বিষ্ণুকে ও ভগবান রুদ্রকেও তুমিই শরীর গ্রহণ করিয়েছ; কাজেই তোমার স্তুতি করার মত শক্তি কার আছে? হে দেবি! তুমি তো নিজের এই উদর প্রভাবের দ্বারাই প্রশংসিত। এই যে দুই দুর্জয় অসুর মধু ও কৈটভ এদের তুমি মোহগ্রস্ত করে দাও এবং জগদীশ্বর ভগবান বিষ্ণুকে শীগগিরই জাগরিত করে দাও। সঙ্গে সঙ্গে এই মহাসুরকে বধ করবার জন্য তাঁর প্রবৃত্তি উৎপাদন কর। ৭৬-৮৭ ॥

ঋষিরুবাচ ।। ৮৮ ৷৷

মেধা ঋষি বললেন-।।৮৮ ॥

এবং স্বতা তদা দেবী তামসী তত্র বেধসা। ৮৯ ৷৷

বিষ্ণোঃ প্রবোধনার্থায় নিহন্তুং মধুকৈটভৌ।
নেত্রাস্যনাসিকাবাহুহৃদয়েভ্যস্তথোরসঃ ॥৯০৷৷

নির্গম্য দর্শনে তন্ত্রৌ ব্রহ্মণোহব্যক্তজন্মনঃ।
উত্তস্থৌ চ জগন্নাথস্তয়া মুক্তো জনার্দনঃ ৷৷ ৯১ ৷৷

একার্ণবেহহিশয়নাত্ততঃ স দদৃশে চ তৌ।
মধুকৈটভৌ দুরাত্মানাবতিবীর্যপরাক্রমৌ। ৯২।

ক্রোধরক্তেক্ষণাবস্তুং ব্রহ্মাণং জনিতোদ্যমৌ।
সমুখায় ততস্তাভ্যাং যুযুধে ভগবান্ হরিঃ। ৯৩ ॥

পঞ্চবর্ষসহস্রাণি বাহুপ্রহরণো বিভুঃ।
তাবপ্যতিবলোন্মত্তৌ মহামায়াবিমোহিতৌ ।। ৯৪ ॥

উক্তবস্তৌ বরোহস্মত্তো ব্রিয়তামিতি কেশবম্ ৷৷ ৯৫ ॥

ব্রহ্মা যখন মধু আর কৈটভকে বধ করবার উদ্দেশ্যে ভগবান বিষ্ণুকে যোগনিদ্রা থেকে জাগাবার জন্য তমোগুণের অধিষ্ঠাত্রী দেবী যোগনিদ্রার এই রকম স্তুতি করলেন, তখন সেই দেবী যোগনিদ্রা ভগবান বিষ্ণুর চোখ, মুখ, নাক, বাহু, হৃদয় এবং বক্ষঃস্থল থেকে নির্গত হয়ে অব্যক্তজন্মা ব্রহ্মার দৃষ্টিগোচর হলেন। যোগনিদ্রা ভেঙ্গে যাওয়ার পর জগন্নাথ ভগবান জনার্দন একীভূত মহাসমুদ্রে অবস্থিত অনন্তশয়ান থেকে জেগে উঠলেন। গাত্রোত্থান করে তিনি ওই দুই অসুরকে দেখলেন তারা, সেই দুরাত্মা, অতি বলবান ও মহাবিক্রমশালী ক্রোধে আরক্ত নয়নে ব্রহ্মাকে ভক্ষণের উদ্যোগ করছিল। অতঃপর ভগবান শ্রীহরি শয্যা ছেড়ে উঠে ওই দুই অসুরের সাথে পাঁচ হাজার বছর ধরে বাহুযুদ্ধ করলেন, ওরা দুজনও অত্যন্ত বলদর্পিত হয়েছিল। এদিকে দেবী মহামায়াও তাদের বিমোহিত করে রেখেছিলেন; ফলে তারা ভগবান বিষ্ণুকে বলল-'আমরা তোমার বীরত্বে সন্তুষ্ট হয়েছি, তুমি আমাদের কাছে বর প্রার্থনা করো।' ॥৮৯-৯৫ ৷

শ্রীভগবানুবাচ ৷৷ ৯৬ ৷৷

শ্রীভগবান বললেন-। ৯৬ ।।

ভবেতামদ্য মে তুষ্টৌ মম বধ্যাবুভাবপি৷৷ ৯৭৷

কিমন্যেন বরেণাত্র এতাবদ্ধি বৃতং মম ৷৷ ৯৮ ॥

তোমরা দুজনে যদি আমার প্রতি প্রসন্ন হয়ে থাক, তবে তোমরা আমার হাতে বধ্য হও। ব্যস্, এইই আমার একান্ত অভিপ্রায়। অন্য বরের আর কী প্রয়োজন? ।। ৯৭-৯৮॥

ঋষিরুবাচ৷৷ ৯৯ ৷৷

মেধা ঋষি বললেন-৷৷ ৯৯ ।।

বঞ্চিতাভ্যামিতি তদা সর্বমাপোময়ং জগৎ৷৷ ১০০ ৷৷

বিলোক্য ত্যাভ্যাং গদিতো ভগবান্ কমলেক্ষণঃ।
আবাং জহি ন যত্রোর্থী সলিলেন পরিপ্লুতা৷৷ ১০১ ৷৷

এইভাবে প্রবঞ্চিত হয়ে যখন তারা সমস্ত জগৎ জলমগ্ন দেখলো, তখন কমলনয়ন ভগবানকে বলল-পৃথিবীর যে জায়গাটা জলমগ্ন হয়নি-যেখানে শুকনো জায়গা আছে, সেইস্থানে আমাদের বধ করো। ১০০-১০১ ৷৷

ঋষিরুবাচ। ১০২৷

মেধা ঋষি বললেন-৷৷ ১০২ ।

তথেত্যুত্ত্বা ভগবতা শঙ্খচক্রগদাভৃতা।
কৃত্বা চক্রেণ বৈ চ্ছিন্নে জঘনে শিরসী তয়োঃ৷৷ ১০৩ ৷৷

এবমেষা সমুৎপন্না ব্রহ্মণা সংস্তুতা স্বয়ম্।
প্রভাবমস্যা দেব্যাস্ত্র ভূয়ঃ শৃণু বদামি তে।। ঐং ওঁ ৷৷ ১০৪ ৷৷

শঙ্খ, চক্র ও গদাধারী ভগবান বিষ্ণু 'তাই হোক' বলে ওদের দুজনের মাথা দুটি নিজের উরুর ওপর রেখে চক্র দিয়ে ছেদন করলেন। এইভাবে এই দেবী মহামায়া ব্রহ্মা কর্তৃক সংস্তুতা হয়ে স্বয়ং আবির্ভূতা হয়েছিলেন। আমি আবার তোমাদের কাছে এই দেবীর মহিমা বা আবির্ভাবের বিষয় বর্ণনা করছি, শোনো ।। ১০৩-১০৪ ৷৷

ইতি শ্রীমার্কণ্ডেয়পুরাণে সাবর্ণিকে মন্বন্তরে দেবীমাহাত্ম্যে মধুকৈটভবধো নাম প্রথমোহধ্যায়ঃ ।। ১ ৷৷ এই অধ্যায়ে উবাচ ১৪, অর্দ্ধশ্লোক-২৪, শ্লোক-৬৬

সর্বমোট-১০৪।

শ্রীমার্কণ্ডেয়পুরাণে সাবর্ণিক মন্বন্তরে দেবীমাহাত্ম্য প্রসঙ্গে 'মধু-কৈটভ-বধ' নামক প্রথম অধ্যায় সম্পূর্ণ হল৷৷ ১ ৷৷